কোলাজেন কি এবং কোলাজেন এর কাজ কি?
কোলাজেন হলো শরীরের কাঠামোগত গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন অণু, যা শরীরের বিভিন্ন সংযোগকারী টিস্যুর প্রধান উপাদান। এবং এটি শরীরের সমস্ত কোষগুলিকে নতুন জীবন দানের জন্য আবশ্যকীয় প্রধান উপাদান। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই কোলাজেনের কার্যকারিতা ও উপকারিতাকে উপেক্ষা করেন। বাস্তবে কোলাজেন আমাদের সকল সংযোগকারী টিস্যুগুলোর ৮০ শতাংশ সুস্থতার জন্য দায়ী।
স্বাভাবিকভাবে সবচেয়ে বেশি কোলাজেন আমাদের ফাইব্রেস (Tendons, Ligaments, Cartilage) টিস্যুগুলোতে পাওয়া যায়। এমনকি চোখের কর্নিয়া (চোখের সাদাঅংশের উপরের স্তর) তরুণাস্থি, রক্তনালী, হাড়, ও অন্ত্রে ভালো পরিমাণ কোলাজেন পাওয়া যায়।
যেহেতু Collagen আমাদের শরীরের অধিকাংশ সেলস (কোষের) এর জন্য অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। তাই সৃষ্টিগতভাবে আমাদের শরীর প্রচুর পরিমাণ কোলাজেন উৎপাদন করে। কিন্তু, আমাদের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শরীরের কোলাজেন তৈরির ক্ষমতা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এমনকি এক পর্যায়ে শরীরে কোলাজেন তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আমরা কোলাজেনির উপকারিতা সমূহ থেকে বঞ্চিত হই এবং আমাদের মধ্যে বার্ধক্য জনিত চিহ্ন, বলিরেখা (wrinkles) ও সূক্ষ্ম লাইন প্রকাশ পেতে শুরু করে। এবং একপর্যায়ে আমাদের মাঝে পূর্ণ বৃদ্ধ হওয়া প্রকাশ পায় ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ি।
গবেষকদের ভাষ্য মতে মানুষ যখন ২৫ বছরে পদার্পণ করে। তখন থেকে তাদের শরীর কোলাজিন উৎপাদন হারাতে শুরু করে। এবং ৩০ বছর বয়সের পর থেকে প্রতি বছর গড়ে তারা তাদের ১.৫% এরও বেশি কোলাজেন প্রোডাকশন হারাতে থাকে। এবং ৪০ এর সংখ্যায় পৌঁছালে দেখতে পাবেন, আপনি ইতোমধ্যেই ১৫% কোলাজিন সংরক্ষণ ও প্রোডাকশন ক্ষমতা হারিয়েছেন। ফলে তখন বার্ধক্য প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কৃত পরিবর্তনগুলো দেখতে পাবেন।
শরীরে কোলাজিন কম থাকলে কি হয়?
বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে আমাদের শরীরে কোলাজেন কমতে থাকে। কোলাজিন পরিপূরক গ্রহণ করে তা পূরণ না করলে শরীরে তার অভাব বা ঘাটতি থেকে যায়। ফলে কোলাজিন এর অভাবে আপনার ত্বক বার্ধক্যের বিভিন্ন চিহ্ন প্রকাশ করবে, এবং কুঁচকানো ত্বক, নীরস, বলিরেখা, সূক্ষ্ম রেখা, দুর্বল পেশী, ও জয়েন্টের স্বাস্থ্য অবনতিসহ আরও অনেক স্বাস্থ্য অবনতি করবে। এমনকি এর অভাব আপনার হার্ট জনিত রোগ, হার্ট অ্যাটাক ও হার্টের রোগ, এবং জয়েন্ট ডেমেজ তথাঃ রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং অস্টিওআর্থারাইটিসের মত রোগ হওয়ার কারণ হতে পারে। সুতরাং আপনার ডাক্তারের পরামর্শে ২৫ উর্ধ বয়সের পর কোলাজেন পাউডার বা ভালো সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করুন। এবং বার্ধক্যের চিহ্ন ও বিভিন্ন রোগ থেকে নিজিকে নিরাপদ রাখুন।
কোলাজেন সমৃদ্ধ খাবার, ক্যাপসুল বা পাউডার সাপ্লিমেন্টের সেরা ১০ টি উপকারিতা
1. কোলাজেন হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য উন্নতিতে সাহায্য করে।
কোলাজিন সাপ্লিমেন্ট আপনার অস্টিওআর্থারাইটিস (বাতব্যথা) এবং অস্টিওপরোসিস বা দুর্বল হাড়ের ঘনত্ব বাড়িয়ে তা মজবুত ও ভাঙ্গা থেকে রক্ষা করে। বিশেষ করে যখন কোলাজিন পরিপূরক ক্যালসিয়ামের সাথে গ্রহণ করা হয় তখন এটি অধিক উপকারিতা পৌঁছায়। কেননা কোলাজেন শরীর কর্তৃক ক্যালসিয়ামকে সর্বোচ্চ মাত্রায় চোষণ করতে সাহায্য করে। এবং নিজেও হাড়ের দুর্বলতা কমাতে এবং হাড়ের স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করে। তাই দেখতে পাবেন যে, অধিকাংশ সময়ই ডাক্তারগণ হাড়ের রোগীদের, কোলাজেন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এর সংমিশ্রণে তৈরীকৃত খাদ্য সম্পূরক বা ফুড সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার পরামর্শ দেন। কারণ এই তিনটি ভিটামিন হাড়ের নমনীয়তা ও স্বাস্থ্য উন্নতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
2. এটি আপনার ত্বকের লাভন্য ও ইলাস্টিসিটি বৃদ্ধি করে।
কোলাজেন আমাদের শরীরের সংযোগকারী টিস্যুগুলিকে একত্রে ধরে রাখে। এবং ত্বকে এমন এক চর্বির স্তর তৈরি করে যেটি আমাদের ত্বককে হাড়ের সাথে শক্ত করে ধরে রাখে। ফলে ত্বক ও চেহারায় লাভন্যতা, উজ্জ্বলতা ও ইলাস্টিসিটি বৃদ্ধি পায়। কেননা আমাদের ত্বককে শক্তিশালী এবং স্বাস্থ্যকর রাখতে আমাদের শরীর তার নিজস্ব Collagen উৎপাদনের উপর নির্ভর করে। কিন্তু আমাদের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শরীরের নিজস্ব কোলাজিন তৈরি শক্তি কমতে থাকে। ফলে খাদ্য সম্পূরক হিসেবে আমাদেরকে Collagen Peptides Supplement গ্রহণ করা লাগে। যেটি শরীরের স্বাভাবিক কোলাজিন তৈরি ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বার্ধক্য জনিত চিহ্ন সমূহ (বলিরেখা, সূক্ষ্ম রেখা, কুঁচকানো ত্বক) দুর করে। এবং লাভন্যতা উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে।
3. কোলাজেন পোড়া এবং ক্ষতস্থান নিরাময় ও রিকভারি করে
স্বাভাবিকভাবে কোলাজিন শরীরের ক্ষতস্থান ও পোড়া স্থানের জন্য প্রাকৃতিক ড্রেসিং হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কারণ কোলাজিন আপনার ক্ষতস্থান ও পোড়াস্থানের নির্গত পুঁজ/পানি শোষণ করে। এবং সকল প্রকার ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক সংক্রমণ ঠেকিয়ে ক্ষতকে নিরাময় করে। এমনকি নতুন ত্বকের বিকাশের জন্য বা স্কিন রিকভারির জন্য কোলাজেন অণুগুলো একত্রিত হয়ে কাজ করে। ফলে ক্ষতস্থান ও পোড়াস্থান আর্দ্র ও ময়েসচুরাইজেড থাকা অবস্থায় দ্রুত নিরাময় লাভ করে।
4. কোলাজেন আপনার দাঁত ও দাঁতের মাড়িকে শক্তিশালী করে।
এই কোলাজেন সাপ্লিমেন্ট আপনার দাঁত গুলোকে তার স্ব-স্থানে একত্রে আবদ্ধ করে রাখতে। এবং দাঁতের মাড়িকে শক্ত করে ধরে রাখতে ও মজবুত করতে সাহায্য করে। দাঁতের ও মাড়ির খারাপ কন্ডিশান হলে, ডাক্তারগণ অনেক সময় তাদেরকে কোলাজিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কারণ, মূলত Collagen ফাইবারস থেকে গঠিত হয়, যেগুলো সংযোগকারী টিস্যুতে থেকে দাঁত ও হাড় তৈরি করে। তাই আপনার দাঁত ও দাঁতের মাড়ির সু-স্বাস্থ্য বজায় রাখতে কোলাজিনের ভালো ভূমিকা থাকে।
5. আপনার চুল এবং নখকে মজবুত ও লম্বা করবে
কোলাজেন আপনার দুর্বল ও ভঙ্গুর নখকে শক্তিশালী করার জন্য, এবং আপনার চুল বৃদ্ধির জন্য ও চুল পড়া বন্ধ করার জন্য সবচেয়ে সেরা খাদ্য সম্পূরক হতে পারে। কারণ এটি শরীরে প্রাকৃতিকভাবে চুল বৃদ্ধিকারী প্রোটিনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। এবং চুলকে লম্বা করে ও ধূসর রঙের চুল কমিয়ে আনতে সাহায্য করে।
6. কোলাজিন আপনার বাতব্যথা, জয়েন্ট বা সংযোগস্থল সমূহের ব্যথা উপশম করে।
কিছু চিকিৎসা গবেষণায় দেখা গেছে যে, কার্টিলেজ টিস্যুতে Collagen যোগ করার মাধ্যমে, অতিরিক্ত কোষ বৃদ্ধি করা সম্ভব। ফলে আপনি আপনার জয়েন্টের গতিশীলতা বৃদ্ধি করতে পারবেন, এবং হাঁটুর ব্যথা, বাতের ব্যথা ও সংযোগস্থল সমূহের উপশম করতে সক্ষম হবেন।
7. কোলাজিন হার্ট এবং কার্ডিওভাসকুলার (রক্তনালীর) স্বাস্থ্য বজায় রাখে।
শরীরে Collagen এর উপস্থিতি কম থাকা বা Collagen প্রোডাকশন কম হওয়া আপনার হার্ট অ্যাটাক ও প্যাথলজিকাল (আবেগপ্রবণ) রোগের কারণ হতে পারে। এবং কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, কোলাজিন Cardiovascular বা হার্ট ও রক্ত নালীকে শক্তিশালী করতে এবং তাদের ইলাস্টিসিটি বাড়াতে সাহায্য করে। যেটি আপনার সমস্ত শরীর জুড়ে রক্ত সঞ্চালন সহজ করে ও বৃদ্ধি করে। ফলে আপনার হার্টের রোগ, হার্ট অ্যাটাক ও হাই ব্লাড প্রেসার হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।
8. আঘাত প্রাপ্তস্থান নিরাময় করে
কোলাজেন আঘাত প্রাপ্তস্থানকে নিরাময় করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। যেহেতু কোলাজিন পেশীগুলোকে নতুন টিস্যু তৈরির জন্য উৎসাহিত করে। এবং নতুন সংযোগকারী টিস্যু নির্মাণ করে আঘাত প্রাপ্তস্থানকে দ্রুত নিরাময় করে। কেননা শরীরে শক্তিশালী পেশী, ত্বক, হাড়, টেন্ডন, ও লিগামেন্টের সু-স্বাস্থ্যের জন্য এবং সংযোগকারী টিস্যুর মেরামত ও পুনর্নির্মাণের জন্য কোলাজেন অতিব-প্রয়োজনীয়।
9. কোলাজেন আপনার শরীরে সেলুলাইট (Cellulite) এর উপস্থিতি কমাতে সাহায্য করে।
স্বাভাবিকভাবে কোলাজেন যেহেতু আমাদের ত্বকের স্বাস্থ্য, মসৃণতা, ইলাস্টিসিটি, ও ত্বককে টাইট রাখার জন্য একটি আদর্শ ও অপরিহার্য পুষ্টি বা ভিটামিন। তাই আপনার শরীরে সেলুলাইট (Cellulite) বা রান ও নিতম্বের ছোট ছোট গর্ত জনিত রোগ নিরাময় করতে ও এই রোগকে শরীরে প্রকাশ হওয়া থেকে বাধা দিতে কোলাজেন একটি ভালো ও পজেটিভ প্রভাব ফেলবে। কারণ কোলাজেন আপনার শরীরের ভিতর থেকেই টিস্যুগুলোর মেরামত ও পুনর্নির্মাণ করে সেলুলাইট কমানোর কাজ করে।
জ্ঞাতব্যঃ সেলুলাইট (Cellulite) কি ও এই সেলুলাইট কেন হয়?
সেলুলাইট (Cellulite) হলো নারীদের উরু ও নিতম্বের ত্বকের ছোট ছোট গর্ত বা ডিম্পল, যেগুলো উরু ও নিতম্বের ত্বকের নিচে ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাওয়া চর্বির বহির প্রকাশ করে। সেলুলাইট তখনই হয়, যখন আমাদের শরীরের চর্বিযুক্ত টিস্যুগুলো ফাইবারসের সাহায্যে ত্বকের উপরের স্তরের উঠে আসে। যার ফলে কখনো কখনো নারী-পুরুষ উভয়েরই নিতম্বে ছোট ছোট গর্ত বা ডিম্পল দেখা দেয়। তবে কোলাজেন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের মাধ্যমে এটি কমানো ও নিরাময় করা যায়। অথবা বিস্তারিত চিকিৎসার জন্য আপনার ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করুন। তথ্যসূত্রঃ
10. কোলাজেন স্বাভাবিকভাবে আপনার সার্বিক সু-স্বাস্থ্য বজায় রাখে।
আশ্চর্যজনক হলেও, এটি সত্য যে কোলাজেন আপনার সার্বিক সু-স্বাস্থ্য বজায় রাখে। এবংসচরাচর অনেক রোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। যেমনঃ কোলাজিন পরিপূরক আপনার দৃষ্টি শক্তির উন্নতি করে, ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ রাখতে সাহায্য করে, স্বাস্থ্যকর HDL কোলোরেক্টল বজায় রাখে, শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি করে, হার্ট অ্যাটাক এর সম্ভাবনা কমায়, এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
কোলাজেন থেকে কিভাবে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হওয়া যায়?
আপনি যদি কোলাজেন সাপ্লিমেন্টের সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন সি গ্রহণ করেন। তাহলে এর দ্বারা আপনি Collagen Peptides এর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং শরীর কর্তৃক তার শোষণ বৃদ্ধি করে, কোলাজেন সাপ্লিমেন্ট থেকে সর্বোচ্চ উপকারিতা নিশ্চিত করতে পারবেন।
কেননা কোলাজিনর উৎপাদন বৃদ্ধি ও তার স্থায়িত্ব এবং গঠন প্রক্রিয়ার জন্য ভিটামিন C একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি। এবং এই ভিটামিন সি কোলাজেনের সমন্বয়ের জন্য ও তার উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য এক অপরিহার্য পুষ্টি। তবে এর পাশাপাশি অ্যামিনো এসিডসগুলোর উপস্থিতিও এক প্রয়োজনীয় বিষয়। যাতে এই সূক্ষ্ম উপাদানটি একটি প্রো-কোলাজেন কাঠামো থেকে প্রকৃত কোলাজিন উপাদানে রূপান্তরিত হয়। তাই কোলাজেন থেকে সর্বোচ্চ উপকার নিশ্চিতে, ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি এবং মাল্টি ভিটামিনস ও মিনেরালস গ্রহণ করুন।
আরও পড়ুনঃ ঘরে বসে কোলাজেন পাউডার বানানোর নিয়ম ও ব্যবহার বিধি।